ডিভোর্স কেন হয় ডিভোর্স হওয়ার কারণ

 ডিভোর্স কেন হয় ডিভোর্স হওয়ার কারণ


বিবাহবিচ্ছেদ (ডিভোর্স) সাধারণত একটি একক কারণে হয় না; এটি দীর্ঘদিন ধরে জমা হওয়া বিভিন্ন সমস্যা ও টানাপোড়েনের ফল। পারিবারিক জীবনে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া, আস্থা এবং সম্মান একেবারেই হারিয়ে যায়, তখনই বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ডিভোর্স হওয়ার প্রধান কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:


১. সম্পর্কের মূল ভিত্তি নষ্ট হওয়া

  • যোগাযোগের অভাব (Lack of Communication): এটি ডিভোর্সের সবচেয়ে সাধারণ কারণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সঠিকভাবে কথা না হওয়া, নিজেদের অনুভূতি ও চাহিদা প্রকাশ না করা অথবা একে অপরের কথা না শোনা—এসব থেকেই দূরত্ব তৈরি হয়।

  • অবিশ্বাস ও সন্দেহ (Trust Issues): বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া, বিশেষ করে পরকীয়ায় (Infidelity) জড়িয়ে পড়া বা এমন আচরণ করা যা সন্দেহের জন্ম দেয়। একবার বিশ্বাস ভেঙে গেলে সম্পর্ক জোড়া লাগানো কঠিন হয়ে পড়ে।

  • সম্মানের অভাব (Lack of Respect): একে অপরকে তুচ্ছ করা, জনসমক্ষে অপমান করা, কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলা—যা সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে দেয়।


২. আর্থিক ও ব্যবহারিক সমস্যা

  • আর্থিক বোঝাপড়ার অভাব (Financial Conflict): টাকা-পয়সা খরচ করা বা জমানো নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়া, অথবা একজন অন্যজনের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপন রাখা বড় ধরনের ঝগড়ার জন্ম দেয়।

  • পারিবারিক চাপ ও হস্তক্ষেপ (Family Interference): শ্বশুরবাড়ির বা অন্য কোনো আত্মীয়ের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা ডিভোর্সের দিকে নিয়ে যায়।

  • ভরণপোষণে ব্যর্থতা: স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হওয়া।


৩. মানসিক ও চারিত্রিক সমস্যা

  • অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক নির্যাতন (Abuse and Control): শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক চাপ, ভয় দেখানো, বা সঙ্গীর ওপর সব বিষয়ে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা বিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ।

  • আসক্তি বা নেশা (Addiction): যেকোনো ধরনের ক্ষতিকর আসক্তি (যেমন: মাদক, জুয়া) পারিবারিক শান্তি ও স্থায়িত্ব নষ্ট করে।

  • যৌন অসঙ্গতি: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক বা যৌন চাহিদার পার্থক্য বা বোঝাপড়ার অভাব দীর্ঘমেয়াদে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।

  • রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা: যেকোনো ছোট বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত রাগারাগি করা বা সহিংস আচরণ করা।


৪. প্রত্যাশা এবং জীবনের লক্ষ্যের পার্থক্য

  • লক্ষ্যের ভিন্নতা: সময়ের সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত লক্ষ্য, জীবনধারা বা ভবিষ্যত পরিকল্পনা ভিন্ন হয়ে যাওয়া।

  • অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব (Incompatible Personality): যদি দুইজনের ব্যক্তিত্ব এমন হয় যে তারা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না, তবে সময়ের সাথে সাথে একত্রে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে।

  • অপূর্ণ প্রত্যাশা: বিবাহের পরে একে অপরের কাছ থেকে যে প্রত্যাশাগুলো ছিল, তা পূরণ না হওয়া বা প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত না হওয়া।


মনে রাখবেন, ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দম্পতিদের জন্য অভিজ্ঞ কাউন্সিলর বা সালিশি পরিষদের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা অত্যন্ত জরুরি। এতে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক রক্ষা করা সম্ভব হয়।

বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স একটি জটিল সামাজিক সমস্যা এবং এর কারণগুলো ব্যক্তিগত, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক হতে পারে। বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির পেছনে যে কারণগুলো প্রধানত কাজ করে, সেগুলোকে কয়েকটি ভাগে আলোচনা করা হলো:


১. সম্পর্কের মূল ভিত্তির অভাব ও বিশ্বাসহীনতা

এগুলো হলো ডিভোর্সের সবচেয়ে বড় এবং সরাসরি কারণ।

  • বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক (Infidelity): এটি ডিভোর্সের অন্যতম প্রধান কারণ। স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো একজনের অন্য কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তৈরি হলে সম্পর্কের বিশ্বাস ভেঙে যায় এবং বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

  • যোগাযোগের অভাব (Lack of Communication): স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খোলাখুলি ও কার্যকর যোগাযোগের অভাবে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে, মনোমালিন্য হয় এবং মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা বা সমস্যা নিয়ে কথা না বলা সম্পর্ককে ভেঙে দেয়।

  • পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব: সঙ্গীকে ছোট করা, অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা অন্যের সামনে অপমান করা—এসব আচরণ সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে।


২. পারিবারিক ও সামাজিক চাপ

  • পারিবারিক সহিংসতা বা গার্হস্থ্য নির্যাতন: শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন ডিভোর্সের একটি বড় কারণ। অনেক নারীই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিচ্ছেদের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।

  • যৌতুক সংক্রান্ত চাপ ও নির্যাতন: যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। বিয়ের পরও যৌতুকের জন্য স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে মানসিক ও শারীরিক চাপ এবং নির্যাতন ডিভোর্সের কারণ হয়।

  • শ্বশুরবাড়ির অত্যধিক হস্তক্ষেপ: স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের (বিশেষত শ্বশুর-শাশুড়ির) অনাকাঙ্ক্ষিত ও অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরায়।


৩. মানসিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা

  • অসঙ্গতি ও মূল্যবোধের পার্থক্য (Incompatibility): জীবনধারণ, ধর্মীয় বিশ্বাস, অর্থনৈতিক লক্ষ্য, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর ও মৌলিক অমিল থাকলে একত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় না।

  • আবেগীয়/মানসিক পরিপক্কতার অভাব: অপরিণত বয়সে বিয়ে এবং ধৈর্য ও সহনশীলতার অভাব অনেক সময় দাম্পত্য সংকটের জন্ম দেয়।

  • নেতিবাচক আচরণ: অতিরিক্ত রাগ, সন্দেহপ্রবণতা, সমালোচনা করার প্রবণতা বা নিজেদের সব সময় ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরার মানসিকতা বিচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করে।

  • মাদকাসক্তি বা আসক্তি: স্বামী বা স্ত্রীর যেকোনো একজনের মাদকাসক্ত বা অন্য কোনো ক্ষতিকর আসক্তিতে জড়িয়ে পড়া দাম্পত্য জীবনকে অসহনীয় করে তোলে।


৪. আর্থিক ও অর্থনৈতিক কারণ

  • আর্থিক টানাপোড়েন বা অসচ্ছলতা: দারিদ্র্য, বেকারত্ব বা আর্থিক অনটন দাম্পত্য জীবনে চাপ সৃষ্টি করে। আয়ের ভিন্নতা, খরচের অভ্যাসে মিল না থাকা বা ঋণ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেও বিচ্ছেদ হতে পারে।

  • ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থতা: স্বামী যদি দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রীর আইনগত ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হন, তবে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স চাইতে পারেন।


৫. শারীরিক ও যৌন সমস্যা

  • যৌনজীবনে অপূর্ণতা: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন চাহিদার পার্থক্য, যৌন সমস্যা বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতার অভাব অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্কে তিক্ততা আনে এবং বিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দেয়।

  • বন্ধ্যাত্ব বা পুরুষত্বহীনতা: এ ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়েও অনেক সময় দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয়, যা বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং আইনি সচেতনতা বাড়ার কারণে অনেক নারীই নির্যাতন বা অপছন্দের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছেন, যা ডিভোর্সের হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন