ডিভোর্স আইন বাংলাদেশ ২০২৫

 ডিভোর্স আইন বাংলাদেশ ২০২৫


আপনার জিজ্ঞাসিত ডিভোর্স আইন বাংলাদেশ ২০২৪ বলতে বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত যে প্রচলিত আইন ও পদ্ধতি রয়েছে, সেটিকে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশে ডিভোর্সের জন্য নতুন কোনো একক আইন সম্প্রতি প্রণয়ন হয়নি; বরং বিভিন্ন ধর্মের জন্য প্রযোজ্য পৃথক আইন এবং ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশই প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।


১. মুসলিম ডিভোর্স আইন (সর্বাধিক প্রচলিত)

বাংলাদেশের বেশিরভাগ নাগরিক মুসলিম হওয়ায়, ডিভোর্সের ক্ষেত্রে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুসরণ করা হয়।

ডিভোর্সের পদ্ধতি ও প্রকারভেদ

পক্ষডিভোর্সের পদ্ধতিআইনি ভিত্তি
স্বামী কর্তৃকতালাক (Talaq): স্বামী যেকোনো সময় তার স্ত্রীকে তালাক ঘোষণা করতে পারেন।১৯ অনুচ্ছেদের ৭ ধারা
স্ত্রী কর্তৃকতালাক-ই-তাফويض (Talaq-e-Tafweez): কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামীকে তালাকের ক্ষমতা স্ত্রীকে অর্পণ করা থাকলে স্ত্রী এই ক্ষমতা বলে তালাক দিতে পারেন।কাবিননামা ও ১৯ অনুচ্ছেদের ৮ ধারা
খোলা (Khula): স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের প্রস্তাব দেওয়া, যা সাধারণত দেনমোহর বা তার অংশবিশেষ ত্যাগের বিনিময়ে হয়। স্বামী রাজি না হলে স্ত্রী আদালতে মামলা করেন।শরিয়াহ ও পারিবারিক আদালত
আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ (জুডিশিয়াল ডিভোর্স): স্ত্রী নিম্নলিখিত কারণে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) অনুযায়ী আদালতে মামলা করতে পারেন:১৯৩৯ সালের আইন
- স্বামী দুই বছর বা তার বেশি সময় ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।
- স্বামী সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে।
- স্বামীর পক্ষ থেকে শারীরিক বা মানসিক নিষ্ঠুরতা (Cruelty) প্রমাণিত হলে।
উভয় কর্তৃকমুবারাত (Mubarat): স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। এটিও নোটিশ জারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।শরিয়াহ ও ১৯ অনুচ্ছেদের ৮ ধারা

বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া (যা না মানলে তালাক কার্যকর হয় না)

স্বামী বা স্ত্রী (তালাক-ই-তাফويض-এর ক্ষেত্রে) যেই তালাক দিক না কেন, তালাক কার্যকর হওয়ার জন্য নিচের তিনটি ধাপ অবশ্যই মানতে হয়:

  1. লিখিত নোটিশ জারি: তালাক ঘোষণার পর লিখিত নোটিশ যত দ্রুত সম্ভব রেজিস্ট্রি ডাকযোগে বা সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার মেয়র/সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং স্ত্রীকে/স্বামীকে পাঠাতে হবে।

  2. সালিসি পরিষদ গঠন: নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপসের জন্য সালিসি পরিষদ (Arbitration Council) গঠন করবেন।

  3. ৯০ দিন অপেক্ষা: নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছানোর তারিখ থেকে ঠিক ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক কার্যকর হবে না (স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত)।


২. অন্যান্য ধর্মের ডিভোর্স আইন

মুসলিম আইন ছাড়া অন্যান্য প্রধান ধর্মাবলম্বীদের বিবাহবিচ্ছেদ বাংলাদেশে আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

ধর্মপ্রযোজ্য আইনপদ্ধতি
হিন্দুকোনো ডিভোর্স আইন নেই। হিন্দু বিবাহ মৃত্যু ব্যতীত অবিচ্ছেদ্য বলে ধরা হয়। তবে হিন্দু বিবাহ আইন, ২০১৭ পাস হওয়ায় এখন ডিভোর্সের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং পারিবারিক আদালতে ডিভোর্স চাওয়া যেতে পারে।আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া হয়, তবে আইনি প্রক্রিয়া এখনও অপেক্ষাকৃত জটিল।
খ্রিস্টানদ্য ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯নির্ধারিত কারণে আদালতের (জেলা আদালত বা হাইকোর্ট বিভাগ) মাধ্যমে ডিভোর্স ডিক্রি (রায়) নিতে হয়।
বিশেষ বিবাহবিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ (আন্তঃধর্মীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহ)।আদালতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

৩. গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি (২০২৪ প্রেক্ষাপটে)

  • দেনমোহর ও ভরণপোষণ: ডিভোর্স যেভাবেই ঘটুক না কেন, স্বামীকে স্ত্রীকে তার বকেয়া দেনমোহর এবং ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ পরিশোধ করতে হয়।

  • সন্তানের হেফাজত: ডিভোর্সের পর সন্তানের হেফাজত (Custody) ও ভরণপোষণের বিষয়টি পারিবারিক আদালত নির্ধারণ করে দেয়।

  • অনলাইন রেজিস্ট্রেশন: যদিও তালাকের পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে হয় না, তবে সরকার বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন ম্যানুয়ালের পাশাপাশি অনলাইন পদ্ধতিতেও করার উদ্যোগ নিয়েছে (যা নিবন্ধনের প্রক্রিয়াকে সহজ করবে, কিন্তু আইনি ধাপগুলো অপরিবর্তিত থাকবে)।

যেহেতু ডিভোর্স প্রক্রিয়া জটিল, তাই সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ নিশ্চিত করতে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের জন্য নির্দিষ্ট কোনো একক আইন নেই, বরং বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য আলাদা আইন রয়েছে। তবে মুসলিমদের জন্য যে আইনটি সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করা হয় এবং যা সময়োপযোগী হয়েছে, তা মূলত মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং এর সংশ্লিষ্ট বিধিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

২০২৪ সাল পর্যন্ত এই আইনে বড় কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন আসেনি, তবে আদালতের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক স্পষ্ট হয়েছে।

বাংলাদেশে ডিভোর্স আইনকে মূলত তিনটি ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে:


১. মুসলিম ডিভোর্স আইন (মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১)

মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদকে 'তালাক' বলা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ধর্মীয় রীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

A. স্বামী কর্তৃক তালাক

স্বামী যেকোনো সময় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন, তবে তা কার্যকর করতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতি বাধ্যতামূলক:

  • তালাক ঘোষণা: স্বামী স্ত্রীকে তালাক উচ্চারণ বা লিখিতভাবে ঘোষণা করবেন।

  • নোটিশ জারি: ঘোষণার পরপরই যত দ্রুত সম্ভব লিখিত নোটিশ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রাপ্তি স্বীকারপত্রের (A/D) মাধ্যমে নিম্নলিখিত দুটি ঠিকানায় পাঠাতে হবে:

    ১. স্ত্রীর ঠিকানায়।

    ২. ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বরাবর।

  • সালিসি পরিষদ: চেয়ারম্যান নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপস বা সমঝোতার জন্য একটি সালিসি পরিষদ (Arbitration Council) গঠন করবেন।

  • কার্যকর হওয়া: নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে পৌঁছানোর তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। এই ৯০ দিনের মধ্যে আপস না হলে এবং নোটিশ প্রত্যাহার না করলে তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। (যদি স্ত্রী গর্ভবতী হন, তবে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।)

B. স্ত্রী কর্তৃক তালাক (তালাক-ই-তাফويض)

স্ত্রী সরাসরি স্বামীকে তালাক দিতে পারেন, যদি কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা তাকে অর্পণ করা থাকে। প্রক্রিয়াটি স্বামীর তালাকের মতোই।

C. আদালতের মাধ্যমে স্ত্রীর ডিভোর্স

যদি স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা দেওয়া না থাকে, তবে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) অনুযায়ী নিম্নলিখিত কারণে ডিভোর্স চেয়ে মামলা করতে পারেন:

  • স্বামী চার বছর বা তার বেশি সময় ধরে নিরুদ্দেশ থাকলে।

  • স্বামী দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।

  • স্বামী শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করলে।

  • স্বামী আইন লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় বিয়ে করলে।


২. হিন্দু ডিভোর্স আইন

সনাতন (হিন্দু) ধর্মে ঐতিহ্যগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। হিন্দু বিবাহকে একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন (মৃত্যু ছাড়া বিচ্ছেদ অসম্ভব) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

  • বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য এখনো কোনো ডিভোর্স আইন প্রণীত হয়নি।

  • তবে স্ত্রী ভরণপোষণ এবং পৃথক থাকার অধিকারের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু এটি বিবাহবিচ্ছেদ বা ডিভোর্স নয়।


৩. খ্রিস্টান এবং বিশেষ বিবাহ আইন

  • খ্রিস্টান ডিভোর্স: খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিবাহবিচ্ছেদ দ্য ডিভোর্স অ্যাক্ট, ১৮৬৯ (The Divorce Act, 1869) অনুযায়ী নির্দিষ্ট কারণে আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

  • বিশেষ বিবাহ: ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অথবা যারা কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি ছাড়া বিয়ে করেন, তাদের ডিভোর্স বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ (Special Marriage Act, 1872) অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।


২০২৪ সালে ডিভোর্স প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

  • দেনমোহর ও ভরণপোষণ: ডিভোর্স যে কারণেই হোক না কেন, স্বামীকে স্ত্রীকে তার বকেয়া দেনমোহর এবং ইদ্দতকালীন (৯০ দিনের) ভরণপোষণ পরিশোধ করতেই হবে।

  • সন্তানের দায়িত্ব: বিবাহবিচ্ছেদের পর অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ভরণপোষণ এবং শিক্ষার দায়িত্ব বাবার। সন্তানের তত্ত্বাবধানের (Custody) ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালত সন্তানের মঙ্গলের বিষয়টি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।

  • অনলাইন রেজিস্ট্রেশন: যদিও ডিভোর্সের প্রক্রিয়াটি সশরীরে করতে হয়, তবে বর্তমানে সরকার বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন অনলাইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে কাজীকে ডিজিটাল মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে।

বিবাহবিচ্ছেদ একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল আইনি প্রক্রিয়া। আপনার নির্দিষ্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক পদক্ষেপ নিতে একজন পারিবারিক আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন