স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম ২০২৫

 স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম ২০২৫


বাংলাদেশে স্বামী বা মুসলিম পুরুষকে সরাসরি ডিভোর্স দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে একজন স্ত্রী হিসেবে আপনি প্রধানত তিনটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এই প্রক্রিয়াগুলো মূলত মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ দ্বারা পরিচালিত হয়।


১. তালাকে তৌফিজ (Delegated Divorce) এর মাধ্যমে ডিভোর্স

এটি স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার সবচেয়ে সহজ ও সরাসরি পদ্ধতি, যদি বিয়ের সময় আপনাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়ে থাকে।

  • ক্ষমতার শর্ত: বিবাহের সময় কাবিননামার ১৮ নং কলামে স্বামীকে যদি স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করার কথা উল্লেখ থাকে এবং সেই কলামটি পূরণ করা থাকে। সাধারণত এখানে শর্ত দেওয়া থাকে যে স্বামী কোনো বিশেষ কাজ করলে (যেমন: দ্বিতীয় বিয়ে করলে, ভরণপোষণ না দিলে বা শারীরিক নির্যাতন করলে) স্ত্রী এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

  • প্রক্রিয়া:

    1. নোটিশ: আপনি আপনার স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভার মেয়র বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে ডিভোর্স কার্যকর করার নোটিশ পাঠাবেন।

    2. কপি প্রদান: একই সাথে স্বামীর ঠিকানাতেও নোটিশের একটি কপি ডাকযোগে (রজিস্ট্রার্ড এডি) পাঠাতে হবে।

    3. সালিশি পরিষদ: নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন, যেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে আপোস-মীমাংসার চেষ্টা করা হবে।

    4. কার্যকর: নোটিশ জারির তারিখ থেকে ৯০ দিন পার হলে এবং এই সময়ের মধ্যে কোনো মীমাংসা না হলে, ডিভোর্স চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।


২. আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স (বিচারিক বিবাহবিচ্ছেদ)

যদি বিয়ের সময় কাবিননামায় আপনাকে তালাকের ক্ষমতা (তালাক-ই-তৌফিজ) দেওয়া না হয়, তবে আপনাকে পারিবারিক আদালতে নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে মামলা করতে হবে।

  • আইন: ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী আপনি নিম্নলিখিত যেকোনো একটি বা একাধিক কারণ দেখিয়ে আদালতে আবেদন করতে পারবেন:

    • স্বামী চার বছর বা তার বেশি সময় নিরুদ্দেশ থাকলে।

    • স্বামী দুই বছর বা তার বেশি সময় স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।

    • স্বামীকে সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হলে।

    • স্বামী তিন বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।

    • স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে, যেমন:

      • অভ্যাসগতভাবে আপনাকে মারধর করলে।

      • আপনার জীবন দুর্বিষহ করে তুললে।

      • আপনার সম্পত্তি নষ্ট করলে বা আপনার আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে।

  • প্রক্রিয়া:

    1. আদালতে মামলা: একজন আইনজীবীর মাধ্যমে পারিবারিক আদালতে (Family Court) মামলা দায়ের করতে হবে।

    2. ডিক্রি: আদালত আপনার আবেদন সঠিক মনে করলে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি (রায়) প্রদান করবেন।

    3. নোটিশ: এই ডিক্রি আদালত কর্তৃক সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান/মেয়রের কাছে পাঠানো হবে এবং সেখান থেকে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।


৩. খোলা বা মোবারাতের মাধ্যমে ডিভোর্স (পারস্পরিক সম্মতি)

আপনি যদি আপনার স্বামীকে তালাকের প্রস্তাব দেন এবং তিনি সেই প্রস্তাবে সম্মত হন, তবে খোলা তালাক বা মোবারাত এর মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব।

  • খোলা (Khula): স্ত্রী স্বামীকে কিছু ক্ষতিপূরণ (সাধারণত দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিয়ে) দেওয়ার বিনিময়ে বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব করেন এবং স্বামী সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিলে বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

  • মোবারাত (Mubarat): যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বিচ্ছেদ চান এবং পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করেন।

  • প্রক্রিয়া: পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে একটি চুক্তি তৈরি করে এবং উপরে উল্লেখিত নোটিশের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে (চেয়ারম্যান/মেয়র এবং স্বামীর কাছে নোটিশ পাঠিয়ে) ডিভোর্স কার্যকর করতে হবে।

পরামর্শ: যেহেতু বিবাহবিচ্ছেদ একটি জটিল আইনি প্রক্রিয়া, তাই পদক্ষেপ নেওয়ার আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পথটি বেছে নেওয়া উচিত।বাংলাদেশে (মুসলিম আইন অনুযায়ী) একজন স্ত্রী প্রধানত তিনটি উপায়ে স্বামীকে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ দিতে পারেন। এটি নির্ভর করে কাবিননামার শর্ত এবং স্বামীর সম্মতির ওপর। নিচে ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটে নিয়মগুলো বিস্তারিতভাবে দেওয়া হলো:

১. তালাক-ই-তৌফিজ (Talaq-e-Tafweez) - অর্পিত বা প্রদত্ত তালাক

এটি হলো সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি, যা কাবিননামার শর্তের ওপর নির্ভর করে।

পদ্ধতি:

  1. কাবিননামা যাচাই: বিবাহের সময় নিকাহনামার (কাবিননামা) ১৮ নং কলামে যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা (তালাক-ই-তৌফিজ) অর্পণ করে থাকেন, তবে স্ত্রী সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

  2. নোটিশ জারি: ক্ষমতা প্রাপ্ত স্ত্রী তাঁর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার মেয়র/সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে লিখিত নোটিশ পাঠাবেন।

  3. স্বামীর কাছে কপি: একই সাথে নোটিশের একটি কপি স্বামীকে রেজিস্টার্ড ডাকযোগে পাঠাতে হবে।

  4. সালিশি পরিষদ: নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার জন্য একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন।

  5. কার্যকর হওয়া: ৯০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও যদি কোনো মীমাংসা না হয় এবং তালাক প্রত্যাহার করা না হয়, তবে তালাকটি কার্যকর হবে।

২. খোলা তালাক (Khula) - পারস্পরিক সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ

যদি স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে না চান এবং স্বামীও ডিভোর্স দিতে সম্মত থাকেন, তবে এটি সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি।

পদ্ধতি:

  1. স্ত্রীর প্রস্তাব: স্ত্রী স্বামীর কাছে বিচ্ছেদের প্রস্তাব করেন। সাধারণত, স্ত্রী এই ক্ষেত্রে তাঁর দেনমোহরের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ দেনমোহর অথবা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন।

  2. স্বামীর সম্মতি: স্বামী সেই প্রস্তাবে সম্মত হলে, এটি খোলা তালাক হিসেবে গণ্য হয়।

  3. আইনি প্রক্রিয়া: এরপর স্বামী ও স্ত্রী আইনজীবীর মাধ্যমে অথবা সরাসরি কাজী অফিসে গিয়ে যৌথভাবে ডিভোর্স কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। এই ক্ষেত্রেও আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী নোটিশ জারি ও সালিশি পরিষদের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।

৩. আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (Judicial Divorce)

যদি স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা (তালাক-ই-তৌফিজ) দেওয়া না হয় এবং স্বামীও খোলা তালাকের জন্য সম্মত না হন, তবে স্ত্রী পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্সের জন্য মামলা করতে পারেন।

আইন: মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) অনুযায়ী স্ত্রী নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট কারণগুলোর যেকোনো একটি বা একাধিক কারণ দেখিয়ে আদালতে মামলা করতে পারেন:

  • স্বামী চার বছর বা তার অধিক সময় নিরুদ্দেশ থাকলে।

  • স্বামী দুই বছর বা তার অধিক সময় স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।

  • স্বামী সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে।

  • স্বামী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর তাঁর দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।

  • স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে (যেমন, নিয়মিত মারধর, খারাপ জীবনযাপন, সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া ইত্যাদি)।

  • স্বামী যদি বিয়ের সময় নপুংসক হয়ে থাকেন এবং তা এখনও বহাল থাকে।

  • স্বামী দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ বা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলে।

  • স্ত্রী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তার অভিভাবক কর্তৃক বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং স্ত্রী ১৯ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এই বিয়ে অস্বীকার করলে (তবে বিয়েতে সহবাস না হলে)।

পদ্ধতি:

  1. পারিবারিক আদালতে মামলা: স্ত্রী উপরোক্ত কোনো একটি বা একাধিক কারণ উল্লেখ করে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করবেন।

  2. আদালতের ডিক্রি: যদি আদালত স্ত্রীর দাবি ন্যায্য মনে করেন, তবে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি (রায়) জারি করবেন।

  3. নোটিশ ও কার্যকারিতা: আদালত কর্তৃক ডিক্রি প্রদানের সাত দিনের মধ্যে সেটির সত্যায়িত কপি সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠানো হবে এবং সেখান থেকে ৯০ দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।


গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য:

  • ডিভোর্সের যেকোনো প্রক্রিয়া একজন রেজিস্টার্ড নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) বা একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা সবচেয়ে নিরাপদ।

  • তালাক কার্যকরের পর অবশ্যই দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর সম্পূর্ণভাবে স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার।

  • ডিভোর্সের ৯০ দিনের মধ্যে যদি স্বামী-স্ত্রী পুনরায় মিলিত হন এবং সহবাস করেন, তবে তালাক প্রত্যাহার হয়ে যায় এবং তাঁদের দাম্পত্য জীবন বহাল থাকে।

  • যদি স্ত্রী গর্ভবতী হন, তবে সন্তানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন