কি কি কারণে ডিভোর্স দেওয়া যায়
ডিভোর্স (তালাক) স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ই দিতে পারেন, তবে দুজনের ক্ষেত্রে আইনগত কারণ ও প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ (The Muslim Family Laws Ordinance, 1961) এবং মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ (The Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) অনুযায়ী এই কারণগুলো নির্ধারিত।
১. স্বামীর ডিভোর্স দেওয়ার কারণ (একতরফা তালাক)
স্বামী যে কোনো কারণ ছাড়াই তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার রাখেন, তবে তাকে অবশ্যই আইনানুগ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট কারণ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না।
পদ্ধতি:
লিখিত তালাকের নোটিশ প্রস্তুত করে স্ত্রীকে এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বরাবর পাঠাতে হবে।
নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে।
২. স্ত্রীর ডিভোর্স দেওয়ার কারণ (কয়েকটি প্রধান উপায়)
স্ত্রীর জন্য তালাক দেওয়ার প্রধানত তিনটি আইনি উপায় রয়েছে।
ক. তালাক-এ-তাফويض (Delegated Right of Divorce)
এটি স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে সহজ ও সরাসরি পদ্ধতি।
কারণ: কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে যদি স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা (তালাক-এ-তাফويض) স্ত্রীকে অর্পণ করে থাকেন, তবে স্ত্রী নিজেই স্বামীর মতোই একতরফাভাবে তালাক দিতে পারেন।
পদ্ধতি: স্বামীকে যে পদ্ধতিতে নোটিশ পাঠাতে হয়, স্ত্রীও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে নোটিশ পাঠাবেন।
খ. খুলা (পারস্পরিক সম্মতিতে বিচ্ছেদ)
যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ই আর একসঙ্গে থাকতে না চান এবং পারস্পরিক সমঝোতায় সম্পর্ক শেষ করতে রাজি হন।
কারণ: স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতি। এক্ষেত্রে স্ত্রী সাধারণত দেনমোহরের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ স্বামীকে ফিরিয়ে দেন।
পদ্ধতি: দেনমোহর বা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সমঝোতা করে দুজনই সই করে ডিভোর্স সম্পন্ন করেন এবং নোটিশ প্রেরণ করেন।
গ. আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স (মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯)
যদি কাবিননামায় স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা দেওয়া না থাকে এবং স্বামী ডিভোর্স দিতে রাজি না হন, তখন স্ত্রী নির্দিষ্ট কিছু আইনগত কারণে আদালতে মামলা দায়ের করে ডিভোর্স চাইতে পারেন।
নিম্নলিখিত কারণগুলোর ভিত্তিতে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারেন:
| আইনগত কারণ | ব্যাখ্যা |
| ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থতা | স্বামী কমপক্ষে দুই বছর ধরে স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে। |
| নিরুদ্দেশ থাকা | স্বামী চার বছর বা তার বেশি সময় ধরে নিরুদ্দেশ থাকলে বা কোনো খোঁজ না থাকলে। |
| দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা | স্বামী যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে। |
| দীর্ঘ কারাদণ্ড | স্বামীর সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ড হলে। |
| গুরুতর অসুস্থতা | স্বামী বিবাহের সময় পুরুষত্বহীন ছিলেন এবং তা অব্যাহত থাকলে, অথবা স্বামী দুই বছর ধরে উন্মাদ বা কুষ্ঠ রোগে ভুগলে। |
| নিষ্ঠুর আচরণ (Cruelty) | স্বামী স্ত্রীর প্রতি শারীরিক বা মানসিক নিষ্ঠুরতা দেখালে, যেমন: গালিগালাজ, মারধর, অনৈতিক জীবনযাপন করতে বাধ্য করার চেষ্টা বা স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে। |
| অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ | স্বামী প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বা ১৯৬১ সালের আইন লঙ্ঘন করে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে। |
উপসংহার:
ডিভোর্স একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে যে পক্ষই তালাক দিতে চান না কেন, আইনি প্রক্রিয়া সঠিকভাবে অনুসরণ করা জরুরি। আপনার পরিস্থিতি অনুযায়ী সবচেয়ে উপযুক্ত উপায় খুঁজে বের করতে একজন পারিবারিক আইন বিষয়ক অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
ডিভোর্স (তালাক) সাধারণত মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ (Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939) অনুযায়ী দেওয়া যায়।
স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের জন্যই তালাক দেওয়ার আইনি অধিকার ও কারণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
১. স্বামীর পক্ষ থেকে ডিভোর্সের কারণ
মুসলিম আইন অনুযায়ী, একজন স্বামী যেকোনো সময়, নির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ না করেও তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। তবে তালাক আইনসম্মতভাবে কার্যকর করতে হলে অবশ্যই ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
কারণ ছাড়াই তালাক: স্বামী তার ইচ্ছামতো যেকোনো সময় স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ পাঠাতে পারেন।
আইনি প্রক্রিয়া:
স্বামীর তালাকের নোটিশটি লিখিত আকারে স্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান/মেয়রকে পাঠাতে হবে।
নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হবে। এই সময়ে সালিশি পরিষদ পুনর্মিলনের চেষ্টা করবে।
২. স্ত্রীর পক্ষ থেকে ডিভোর্সের কারণ (তিনভাবে)
স্ত্রীর জন্য ডিভোর্স প্রক্রিয়া সাধারণত তিনটি উপায়ে সম্পন্ন হতে পারে:
ক. তালাক-এ-তাফويض (Delegate Divorce)
এটি ডিভোর্সের সবচেয়ে সহজ প্রক্রিয়া যদি বিয়ের সময় এর অধিকার স্ত্রীকে দেওয়া থাকে।
কারণ: কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা (তালাক-এ-তাফويض) অর্পণ করে থাকেন, তবে স্ত্রী নিজে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্বামীকে তালাক দিতে পারেন।
প্রক্রিয়া: স্ত্রী নিজেই স্বামীর মতো চেয়ারম্যান/মেয়রকে নোটিশ পাঠিয়ে ডিভোর্স কার্যকর করতে পারেন।
খ. খুলা তালাক (Mutual Consent Divorce)
যখন স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ চান।
কারণ: স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যদি একত্রে থাকতে অপারগ হন এবং সম্পর্ক শেষ করতে চান।
প্রক্রিয়া: স্ত্রী সাধারণত দেনমোহরের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে তালাক চান। এটি একটি চুক্তির মাধ্যমে হয় এবং আইনগত প্রক্রিয়া সাধারণত দ্রুত সম্পন্ন হয়।
গ. আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স (স্ত্রী কর্তৃক দাবি)
যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা না দেওয়া থাকে বা স্বামী তালাক দিতে রাজি না হন, তখন স্ত্রী 'মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯' অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে মামলা করে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারেন। এই আইনের অধীনে স্ত্রী নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট কারণগুলো দেখাতে পারেন:
| কারণসমূহ (ধারা-২) | বিবরণ |
| ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থতা | স্বামী যদি দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হন। |
| স্বামীর নিরুদ্দেশ | স্বামী যদি চার বছর বা তার বেশি সময় ধরে নিরুদ্দেশ থাকেন এবং তার কোনো খবর না পাওয়া যায়। |
| বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা | স্বামী যদি তিন বছর ধরে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তার বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। |
| কারাদণ্ড | স্বামীর যদি সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ড হয়। |
| পুরুষত্বহীনতা | স্বামী যদি বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন ছিলেন এবং এখনো তা অব্যাহত থাকে। |
| মানসিক বা শারীরিক অসুস্থতা | স্বামী যদি দুই বছর ধরে উন্মাদ বা কুষ্ঠ/যৌন রোগে ভোগেন। |
| নিষ্ঠুর আচরণ | স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে শারীরিক বা মানসিক নিষ্ঠুর আচরণ করেন (যেমন: মারধর, চরিত্রহীন মহিলাদের সাথে মেলামেশা, অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা)। |
| একাধিক স্ত্রী থাকা | স্বামী যদি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বা আইন লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না করেন। |
| বিয়ে প্রত্যাখ্যান (Option of Puberty) | ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হলে, স্ত্রী ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগে সেই বিয়ে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, যদি তাদের মধ্যে সহবাস (Consummation) না হয়ে থাকে। |
| অন্যান্য কারণ | মুসলিম আইন অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য বৈধ অন্য যেকোনো কারণ। |
ডিভোর্সের প্রক্রিয়াটি আইনি এবং সংবেদনশীল হওয়ায়, আপনার নির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য একজন পারিবারিক আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করা সবচেয়ে সঠিক হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন