ইসলামে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম

 ইসলামে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম


ইসলাম ধর্ম তালাক বা ডিভোর্সকে একটি অনুমোদিত কিন্তু অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ হিসেবে দেখে। কোরআন ও সুন্নাহতে তালাকের সুস্পষ্ট ও পর্যায়ক্রমিক নিয়ম দেওয়া হয়েছে, যাতে আবেগের বশে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।

ইসলামে ডিভোর্স বা তালাক দেওয়ার নিয়ম মূলত তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত, যা নির্ভর করে কে তালাক দিচ্ছেন এবং কীভাবে দেওয়া হচ্ছে তার ওপর।


১. স্বামী কর্তৃক তালাক (তালাক-এ-সুন্নাহ)

স্বামী কর্তৃক তালাক দেওয়ার এটিই সবচেয়ে উত্তম ও শরিয়তসম্মত পদ্ধতি। এর লক্ষ্য হলো মীমাংসার সুযোগ রাখা।

পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি

  1. প্রথম তালাক (তালাক-এ-আহসান):

    • স্বামী স্ত্রীকে একবার 'তালাক' বলবেন বা লিখিতভাবে জানাবেন।

    • তালাকটি অবশ্যই এমন তুহুর বা পবিত্র অবস্থায় (মাসিক ঋতুস্রাবমুক্ত সময়) দিতে হবে, যে সময়ে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়নি।

  2. ইদ্দতকাল পালন:

    • তালাক দেওয়ার পর স্ত্রীকে তিনটি মাসিক ঋতুস্রাবের সময়কাল (বা প্রায় তিন মাস) অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়কে ইদ্দতকাল বলে।

    • ইদ্দত চলাকালীন স্ত্রী স্বামীর বাড়িতেই থাকবেন এবং স্বামী তার ভরণপোষণ দেবেন।

  3. পুনর্মিলনের সুযোগ (রুজু):

    • ইদ্দতকালের মধ্যে স্বামী চাইলে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে (রুজু করতে) পারেন। এই পুনর্মিলনের জন্য নতুন করে বিবাহের প্রয়োজন হয় না।

  4. তালাক কার্যকর:

    • যদি ইদ্দতকাল শেষ হয়ে যায় এবং স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেন, তবে তালাকটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে এবং বিবাহবন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। এই ক্ষেত্রে পুনরায় ঘর-সংসার করতে চাইলে নতুন করে আকদ (বিবাহ) করতে হবে।

    • এভাবে একবার বা দুইবার তালাক দিয়ে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু তৃতীয়বার তালাক দেওয়ার পর সেই সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে ছিন্ন হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আর পুনর্মিলনের সুযোগ থাকে না, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করেন এবং সেই বিয়ে বিচ্ছেদ হয়।

সতর্কীকরণ: তালাক-এ-বিদাআত (একসঙ্গে তিন তালাক)

এক বৈঠকে বা এক কথায় একসঙ্গে তিন তালাক (যেমন: 'তোমাকে তিন তালাক দিলাম') দেওয়া শরিয়তে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ (হারাম) কাজ। তবে বেশিরভাগ ফিকাহবিদদের (আইনজ্ঞ) মতে, এভাবে তালাক দিলেও তা কার্যকর হয়ে যায় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে।


২. স্ত্রী কর্তৃক বিচ্ছেদ

স্ত্রীর জন্যও ইসলামে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার অধিকার রয়েছে:

  • তালাক-ই-তৌফিজ (অর্পিত তালাক): বিবাহের সময় কাবিননামার মাধ্যমে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা (তালাক-ই-তৌফিজ) অর্পণ করে থাকেন, তবে স্ত্রী সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তালাক দিতে পারেন।

  • খোলা তালাক (Khula): যদি স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে থাকতে কোনোভাবেই শান্তি অনুভব না করেন, তবে তিনি দেনমোহরের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে স্বামীর কাছে বিচ্ছেদের প্রস্তাব করতে পারেন। স্বামী সম্মত হলে এই বিচ্ছেদ কার্যকর হয়।


৩. বিচ্ছেদের চূড়ান্ত ধাপ (আইনি প্রক্রিয়া)

যদিও শরিয়ত অনুযায়ী স্বামী বা স্ত্রীর ঘোষণা তালাক কার্যকর করে, কিন্তু আইনি ও সামাজিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশে নিচে দেওয়া প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়:

  1. নোটিশ প্রদান: তালাক দেওয়ার পর স্বামী বা স্ত্রী (তালাক-ই-তৌফিজের ক্ষেত্রে) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/পৌরসভার মেয়র/সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাবেন।

  2. মীমাংসা পরিষদ: নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান/মেয়র উভয় পক্ষকে নিয়ে মীমাংসা বা আপসের জন্য একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন।

  3. কার্যকর হওয়া: নোটিশ জারির ৯০ দিন পার হওয়ার পর এবং এর মধ্যে আপস না হলে তালাকটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়।

  4. ইদ্দত পালন: ডিভোর্সের পর স্ত্রীকে অবশ্যই ইদ্দতকাল (তিন মাসিক ঋতুস্রাব) শেষ করতে হবে। ইদ্দত শেষ হওয়ার আগে তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না।

সংক্ষেপে, ইসলামে তালাক দেওয়ার পদ্ধতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই সম্পর্কের মূল্যায়ন ও পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকে। এটি চূড়ান্তভাবে তখনই অনুমোদিত যখন শান্তি ও সহাবস্থানের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

ইসলাম ধর্ম তালাক বা ডিভোর্সকে একটি অনুমোদিত কিন্তু অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ হিসেবে দেখে। কোরআন ও সুন্নাহতে তালাকের সুস্পষ্ট ও ধীরগতি সম্পন্ন প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে যেন আবেগের বশে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ থাকে।

ইসলামে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়মকে প্রধানত তিনটি ভাগে আলোচনা করা যায়:


১. স্বামী কর্তৃক তালাক (তালাক-এ-সুন্নাহ)

ইসলামে তালাক দেওয়ার সবচেয়ে উত্তম ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হলো তালাক-এ-সুন্নাহ। এর উদ্দেশ্য হলো সম্পর্ক রক্ষার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া।

ক. উত্তম পদ্ধতি (তালাক-এ-আহসান)

এটি তালাকের সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।

  1. এক তালাক প্রদান: স্বামী স্ত্রীকে যখন তিনি মাসিক ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত (তুহুর বা পবিত্র অবস্থায়) এবং ওই পবিত্র অবস্থায় তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়নি, তখন একবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করবেন।

  2. ইদ্দতকাল গণনা: তালাক দেওয়ার পর স্ত্রী তিন মাসিক ঋতুস্রাব পর্যন্ত ইদ্দতকাল (অপেক্ষার সময়কাল) পালন করবেন। এই সময় তিনি স্বামীর ঘরেই অবস্থান করবেন।

  3. ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ (রুজু): ইদ্দতকালীন সময়ে স্বামী চাইলে স্ত্রীকে মৌখিকভাবে বা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ফিরিয়ে নিতে (রুজু) পারবেন। এর জন্য নতুন করে বিবাহের প্রয়োজন হবে না।

  4. চূড়ান্ত বিচ্ছেদ: যদি ইদ্দতকাল শেষেও স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেন, তবে তালাকটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। এটি তখন এক বায়েন তালাক হিসেবে গণ্য হবে, তবে স্বামী-স্ত্রী চাইলে নতুন করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

খ. পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি (তালাক-এ-হাসান)

স্বামী যদি প্রথম তালাকের পর স্ত্রীকে ইদ্দতকালে ফিরিয়ে নেন, কিন্তু পরে আবার সম্পর্কের অবনতি হলে:

  1. পরবর্তী তুহুর (পবিত্রতা)-এর সময় দ্বিতীয়বার এক তালাক দেবেন।

  2. এক্ষেত্রেও একই নিয়মে ইদ্দতকাল পালন ও ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে।

  3. যদি দ্বিতীয় ইদ্দতকাল শেষেও ফিরিয়ে না নেন, তবে বিচ্ছেদ কার্যকর হবে।

তৃতীয়বার এভাবে তালাক দিলে তা চূড়ান্তভাবে (তালাক-এ-মুগাল্লাজা) কার্যকর হবে এবং স্ত্রীকে পুনরায় বিয়ে করা হারাম হয়ে যাবে, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং সেই সম্পর্কও ভেঙে যায়।


২. স্ত্রী কর্তৃক বিচ্ছেদ

ইসলাম স্ত্রীকে সরাসরি তালাকের ক্ষমতা না দিলেও, বিচ্ছেদের অধিকার নিশ্চিত করেছে।

  • তালাক-ই-তৌফিজ (অর্পিত তালাক): বিবাহের সময় কাবিননামার মাধ্যমে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করেন, তবে স্ত্রী সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারবেন।

  • খোলা তালাক (Khula): যদি স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে মানসিকভাবে অপারগ হন, তবে তিনি দেনমোহরের সম্পূর্ণ বা আংশিক অংশ ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে স্বামীর কাছে বিচ্ছেদের প্রস্তাব করতে পারেন। স্বামী সম্মত হলে এটি কার্যকর হয়। যদি স্বামী রাজি না হন, তবে স্ত্রী ইসলামী আদালতের (কাজি/ফ্যামিলি কোর্ট) মাধ্যমে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন।

  • ফাসখ (আদালতের মাধ্যমে বাতিল): স্বামী যদি ভরণপোষণ না দেন, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করেন, দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন বা নিরুদ্দেশ হন, তবে স্ত্রী ইসলামী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বাতিল (ফাসখ) করার আবেদন করতে পারেন।


৩. গুরুত্বপূর্ণ দিক ও সতর্কতা

  • একসাথে তিন তালাক: এক বৈঠকে বা একবারে তিন তালাক উচ্চারণ করা ইসলামে তালাক-এ-বিদআত বা গর্হিত পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত। অধিকাংশ ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, যদিও এটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়ে যায়, তবে এর জন্য স্বামী গুনাহগার হন, কারণ এটি সুন্নাহর পদ্ধতির লঙ্ঘন।

  • ইদ্দতকাল: তালাকের পর স্ত্রীকে অবশ্যই ইদ্দতকাল পালন করতে হয়। এই সময়ে স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করতে পারবেন না। এই সময়কাল গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করা এবং স্বামী-স্ত্রীকে পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

  • দেনমোহর ও ভরণপোষণ: ডিভোর্স যেই দিক থেকেই হোক না কেন (যদি না খোলা তালাকের মাধ্যমে দেনমোহর ছাড় দেওয়া হয়), স্ত্রী তাঁর সম্পূর্ণ দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। এছাড়া ইদ্দতকালীন সময়ে স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকেন।

ইসলামে তালাক কেবল তখনই বৈধ যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। এটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সর্বশেষ উপায় হিসেবে আসে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন