ব্যবস্থাপনার জনক কে এবং কেন
ব্যবস্থাপনার জনক হিসেবে হেনরি ফেয়লকে (Henri Fayol) ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও ফ্রেডরিক উইন্সলো টেইলরকে "বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক" বলা হয়, তবে সামগ্রিক আধুনিক ব্যবস্থাপনার তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপনের জন্য হেনরি ফেয়লকেই প্রধানত এই উপাধি দেওয়া হয়।
কেন তাকে ব্যবস্থাপনার জনক বলা হয়?
হেনরি ফেয়ল একজন ফরাসি খনি প্রকৌশলী এবং ব্যবস্থাপনা তাত্ত্বিক ছিলেন। তিনি ১৯১৬ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Administration Industrielle et Générale প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ব্যবস্থাপনার সার্বজনীনতা এবং এর কার্যাবলী ও নীতিসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি যা কিছু উপস্থাপন করেছেন, সেগুলোই আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়।
তার অবদানের মূল কারণগুলো নিচে দেওয়া হলো:
ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী নির্ধারণ: ফেয়ল প্রথম ব্যক্তি যিনি ব্যবস্থাপনার কাজকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ভাগে বিভক্ত করেন। তার মতে, ব্যবস্থাপনার প্রধান পাঁচটি কাজ হলো: ১. পরিকল্পনা (Planning), ২. সংগঠন (Organizing), ৩. নির্দেশদান (Commanding), ৪. সমন্বয়সাধন (Coordinating) এবং ৫. নিয়ন্ত্রণ (Controlling)। এই কার্যাবলীগুলো আজও ব্যবস্থাপনার মৌলিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত।
ব্যবস্থাপনার ১৪টি মূলনীতি: তিনি ব্যবস্থাপনার ১৪টি নীতি প্রণয়ন করেন, যা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। এই নীতিগুলো ব্যবস্থাপকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সাহায্য করে। উল্লেখযোগ্য কিছু নীতি হলো: কার্য বিভাজন, কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব, নিয়মানুবর্তিতা, আদেশের ঐক্য, নির্দেশনার ঐক্য, এবং একতাই বল।
সার্বজনীন তত্ত্বের প্রবর্তন: ফেয়ল প্রমাণ করেন যে, ব্যবস্থাপনা শুধু শিল্প-কারখানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান—ব্যবসায়িক, সরকারি, সামরিক বা ধর্মীয়—সর্বত্রই সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি ব্যবস্থাপনাকে একটি স্বতন্ত্র জ্ঞান শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন, যা এর আগে ছিল না।
এই কারণগুলোর জন্যই হেনরি ফেয়লকে আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই ভিডিওটিতে হেনরি ফেয়লের ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞাটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।
ব্যবস্থাপনার জনক হিসেবে সাধারণত পিটার এফ. ড্রাকারকে (Peter F. Drucker) গণ্য করা হয়। যদিও ফ্রেডরিক উইন্সলো টেইলরকে "বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক" এবং হেনরি ফেয়লকে "প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার জনক" বলা হয়, আধুনিক ব্যবস্থাপনার বিস্তৃত ধারণার জন্য পিটার ড্রাকারকেই সবচেয়ে বেশি সম্মান জানানো হয়।
কেন তাকে ব্যবস্থাপনার জনক বলা হয়?
পিটার ড্রাকারকে আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক বলার প্রধান কারণ হলো, তিনি ব্যবস্থাপনার প্রচলিত ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে একে একটি স্বতন্ত্র শৃঙ্খলা বা ডিসিপ্লিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৌলিক ধারণাগুলো আজও ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান হলো:
জ্ঞানভিত্তিক কর্মী (Knowledge Worker) ধারণা: তিনি সর্বপ্রথম বলেন যে, আধুনিক যুগে কর্মীর শারীরিক শ্রমের চেয়ে তার মেধা ও জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। তিনি এই জ্ঞানভিত্তিক কর্মীদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও তাদের ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন।
উদ্দেশ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা (Management by Objectives - MBO): ড্রাকার এই ধারণাটি প্রবর্তন করেন, যেখানে কর্মীর নিজস্ব লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক লক্ষ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। এর ফলে কর্মীরা নিজেদের কাজের প্রতি আরও বেশি দায়বদ্ধ ও উৎসাহিত হয়।
বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা (Decentralization): তিনি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতাকে শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিচের স্তরের কর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত হয় এবং কর্মীরা ক্ষমতায়িত বোধ করে।
ব্যবস্থাপনাকে একটি মানবীয় শিল্প হিসেবে দেখা (Management as a Liberal Art): ড্রাকার মনে করতেন, ব্যবস্থাপনা শুধু কিছু নিয়মকানুন বা কৌশলের সমষ্টি নয়, এটি একটি বিস্তৃত মানবীয় শিল্প, যা সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং দর্শনের মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত।
পিটার ড্রাকার তার বিভিন্ন বই, বিশেষ করে 'The Practice of Management' (1954) এর মাধ্যমে ব্যবস্থাপনাকে একটি সুশৃঙ্খল এবং ফলপ্রসূ কাঠামো হিসেবে উপস্থাপন করেন, যা আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি স্থাপন করে।
إرسال تعليق