ডিভোর্স সম্পর্কে ইসলাম কি বলে

 ডিভোর্স সম্পর্কে ইসলাম কি বলে


ইসলাম বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাককে একটি বৈধ, তবে অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ হিসেবে দেখে। এটি এমন একটি সর্বশেষ পন্থা, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হয় না।

ইসলামে ডিভোর্স সম্পর্কে মূল বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হলো:


১. ইসলামের দৃষ্টিতে তালাকের অবস্থান

ইসলামে পারিবারিক বন্ধনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তালাককে কখনোই উৎসাহিত করা হয় না, বরং এটিকে একটি "সর্বনিকৃষ্ট হালাল" বা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত বৈধ কাজ বলা হয়েছে।

  • ঘৃণিত বৈধতা: হাদিসে এসেছে, "আল্লাহর কাছে হালাল বিষয়ের মধ্যে তালাকের চেয়ে অধিকতর ঘৃণিত আর কিছু নেই।" (আবু দাউদ)

  • উদ্দেশ্য: তালাকের উদ্দেশ্য হলো স্বামী-স্ত্রীকে জুলুম, কষ্ট ও অশান্তি থেকে মুক্তি দেওয়া, যখন তাদের সম্পর্ক বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং মিলেমিশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


২. তালাকের আগে সংশোধনের পদক্ষেপ

ইসলামে হঠাৎ করে তালাক দেওয়াকে সমর্থন করা হয় না। বরং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ক্রমান্বয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:

  1. নরম ভাষায় বোঝানো: প্রথমে স্বামী স্ত্রীকে শান্তভাবে বোঝাবেন এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার চেষ্টা করবেন।

  2. শয্যা পৃথক করা: এতে কাজ না হলে স্বামী সাময়িকভাবে স্ত্রীর সাথে এক বিছানায় রাতযাপন থেকে বিরত থাকতে পারেন, যাতে স্ত্রী সতর্ক হন এবং নিজেকে সংশোধন করেন।

  3. সালিশি পরিষদ: উপরের দুটি পদ্ধতি ব্যর্থ হলে, উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে একজন করে সালিস (মীমাংসাকারী) নিযুক্ত করা হবে। তাঁদের কাজ হলো উভয়ের সমস্যা শুনে ঐক্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করা। (সূরা আন-নিসা: ৩৫)

এই সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই চূড়ান্তভাবে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।


৩. তালাক প্রদানের পদ্ধতি (তালাক-এ-আহসান)

ইসলামে তালাক প্রদানের সবচেয়ে উত্তম ও অনুমোদিত পদ্ধতি হলো তালাক-এ-আহসান। এর উদ্দেশ্য হলো পুনর্মিলনের সুযোগ রাখা।

  • নিয়ম: স্বামী এক তুহুরে (মাসিক পিরিয়ড থেকে পবিত্র অবস্থায়) একবার তালাক উচ্চারণ করবেন। এরপর স্ত্রীকে তিন মাসিক বা ঋতুস্রাবকাল (ইদ্দত) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

  • পুনর্মিলন: ইদ্দতকালীন সময়ের মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবেন। এই সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পুনরায় মিলিত হলেই তালাকটি প্রত্যাহার হয়ে যাবে এবং নতুন করে বিয়ের প্রয়োজন হবে না।

  • চূড়ান্ত বিচ্ছেদ: যদি ইদ্দত শেষে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেন, তবে তালাকটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। তখন তারা নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন (যদি প্রথম বা দ্বিতীয় তালাক হয়)।

ইসলাম মোট তিন তালাকের অধিকার দিয়েছে। প্রথম দুই তালাকের পর স্বামী ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারেন বা ইদ্দত শেষে নতুন করে বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু তৃতীয় তালাকের পর সেই স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার কোনো সুযোগ থাকে না, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষকে স্বাভাবিকভাবে বিবাহ করে এবং সেই স্বামীর সাথেও বিচ্ছেদ হয়ে যায়।


৪. স্ত্রীর অধিকার (খোলা ও তালাক-ই-তৌফিজ)

তালাক দেওয়ার প্রাথমিক ক্ষমতা স্বামীর হাতে থাকলেও, ইসলাম স্ত্রীকে বিচ্ছেদের অধিকার দিয়েছে:

  • খোলা (Khula): স্ত্রী যদি স্বামীকে অপছন্দ করেন বা স্বামীর সাথে থাকা তার জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে, তবে তিনি স্বামীর কাছে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন। সাধারণত, স্ত্রী এই ক্ষেত্রে তার দেনমোহরের কিছু অংশ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বিচ্ছেদ লাভ করেন।

  • তালাক-ই-তৌফিজ (Talaq-e-Tafweez): বিয়ের সময় কাবিননামার মাধ্যমে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে থাকেন, তবে স্ত্রী সেই ক্ষমতা বলে স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারেন।

সংক্ষেপে, ইসলামে বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন এবং তা রক্ষা করা অপরিহার্য। তবে যখন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তালাক একটি শেষ অবলম্বন হিসেবে অনুমোদিত, তবে তা অবশ্যই শরীয়তের নির্ধারিত নিয়ম ও পদ্ধতি মেনে হতে হবে।

ইসলাম ধর্ম বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাককে একটি বৈধ কিন্তু অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ হিসেবে দেখে। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা, তবে যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক এমন তিক্ত পর্যায়ে পৌঁছায় যে একত্রে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তালাকের বিধানকে নিরুপায় অবস্থায় শেষ উপায় হিসেবে অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ইসলাম তালাক সম্পর্কে যে মূলনীতিগুলো বলে, তা নিচে তুলে ধরা হলো:


১. ইসলামের দৃষ্টিতে তালাকের গুরুত্ব

  • সর্বাধিক ঘৃণিত হালাল: মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "আল্লাহর কাছে হালাল (বৈধ) কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপছন্দনীয় বা ঘৃণিত হলো তালাক।" (আবু দাউদ)

  • মীমাংসার চেষ্টা আবশ্যক: তালাক দেওয়ার আগে ইসলামে কঠোরভাবে মীমাংসার চেষ্টা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, "যদি তাদের (স্বামী-স্ত্রী) মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা করো, তবে তোমরা পুরুষের পরিবার থেকে একজন এবং নারীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করো। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মিলনের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন।" (সূরা আন-নিসা: ৩৫)

  • তাড়াহুড়ো না করা: ইসলামে তালাককে আবেগ বা রাগের বশে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হিসেবে নিতে নিষেধ করা হয়েছে। তালাকের বিধান হলো সতর্ক করার পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি।


২. ইসলামে তালাকের প্রকারভেদ ও নিয়ম

ইসলামে তালাকের ক্ষমতা মূলত স্বামীর হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, তবে স্ত্রীর জন্যও বিচ্ছেদের অধিকার রয়েছে।

ক. স্বামী কর্তৃক তালাক (তালাক-এ-সুন্নাহ)

ইসলামে তালাক প্রদানের সবচেয়ে উত্তম ও সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো:

  • এক তালাক: স্বামী স্ত্রীকে একবার তালাক শব্দটি উচ্চারণ করবেন বা লিখিতভাবে জানাবেন।

  • ইদ্দতকাল (অপেক্ষার সময়কাল): তালাক ঘোষণার পর স্ত্রীকে তিনটি মাসিক ঋতুস্রাবের সময়কাল (বা প্রায় তিন মাস) অপেক্ষা করতে হয়। একে ইদ্দতকাল বলা হয়।

  • পুনর্মিলনের সুযোগ: এই ইদ্দতকালের মধ্যে স্বামী চাইলে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে (রুজু করতে) পারেন, এতে নতুন করে বিয়ের প্রয়োজন হয় না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসলাম দম্পতিদেরকে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য সময় দেয়।

  • চূড়ান্ত বিচ্ছেদ: যদি ইদ্দতকাল শেষেও স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেন, তবে তালাকটি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়ে যায়। এভাবে একবার বা দুইবার তালাক দিয়ে ফিরিয়ে নেওয়ার পর আবার নতুন বিবাহের মাধ্যমে সংসার করা যায়। তবে তিন তালাক (একসাথে বা পর্যায়ক্রমে) দিলে সেই সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে ছিন্ন হয়ে যায় এবং ইদ্দতের পর তারা আর বিয়ে করতে পারেন না, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য একজনকে বিয়ে করে আবার তালাকপ্রাপ্ত হন।

খ. স্ত্রী কর্তৃক বিচ্ছেদ

স্ত্রীরও বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করার অধিকার রয়েছে:

  • তালাক-ই-তৌফিজ (অর্পিত তালাক): যদি বিয়ের সময় কাবিননামায় স্বামী স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করেন, তবে স্ত্রী সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।

  • খোলা তালাক (Khula): যদি স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে একেবারেই না চান, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ (সাধারণত দেনমোহরের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ অংশ ফেরত দিয়ে) প্রদানের বিনিময়ে স্বামীর কাছে বিচ্ছেদের প্রস্তাব করতে পারেন। স্বামী সম্মত হলে এটি কার্যকর হয়।

গ. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ (ফাসখ)

স্বামী যদি তালাক না দেন এবং স্ত্রী খোলা তালাকের মাধ্যমেও বিচ্ছেদ ঘটাতে না পারেন, তবে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে স্ত্রী ইসলামী আদালতের (যেমন: বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত) মাধ্যমে বিয়ে বাতিলের (ফাসখ) আবেদন করতে পারেন।


৩. তালাকের অন্যান্য বিধান

  • দেনমোহর: তালাকের পর স্ত্রী তাঁর সম্পূর্ণ দেনমোহর (যদি তা পরিশোধ করা না হয়ে থাকে) প্রাপ্য হন।

  • ** ভরণপোষণ:** ইদ্দত চলাকালীন সময়ে স্ত্রীর ভরণপোষণ এবং সন্তানের থাকলে তাদের ভরণপোষণ বহন করা স্বামীর দায়িত্ব।

  • ইদ্দত: ডিভোর্সপ্রাপ্ত নারীকে ইদ্দতকাল (সাধারণত তিন মাসিক ঋতুস্রাবের সময়কাল) শেষ হওয়ার আগে অন্য কাউকে বিয়ে করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

সংক্ষেপে, ইসলামে বিবাহবন্ধন একটি পবিত্র চুক্তি। তালাক সেই বন্ধন ছিন্ন করার একটি শেষ দরজা, যা শুধুমাত্র তখনই ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে যখন সম্পর্ক রক্ষার আর কোনো উপায় বাকি থাকে না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন