ঝগড়া না করায় স্বামীকে ডিভোর্স
সাধারণত ঝগড়া, নির্যাতন বা অবিশ্বাস ডিভোর্সের মূল কারণ হলেও, ঝগড়া না হওয়ার কারণে ডিভোর্স চাওয়া একটি অস্বাভাবিক মনে হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি গভীর মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের পরিস্থিতিকে সম্পর্কের ক্ষেত্রে "নীরব বিচ্ছেদ" (Silent Divorce) বা "আবেগিক বিচ্ছিন্নতা" (Emotional Detachment) হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বিশেষ করে, বাইরের বিশ্বের কাছে একটি সম্পর্ক শান্ত ও নিখুঁত মনে হলেও, ভেতরে ভেতরে এর মূল ভিত্তি ভেঙে যেতে পারে।
ঝগড়া না হওয়ায় ডিভোর্সের সম্ভাব্য কারণসমূহ
সম্পর্কের মধ্যে ঝগড়া বা মতানৈক্য না থাকার কারণে বিচ্ছেদ চাওয়ার পেছনে নিম্নোক্ত কারণগুলো থাকতে পারে:
১. আবেগিক বিচ্ছিন্নতা (Emotional Disconnection)
দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া না হওয়া সবসময় শান্তির লক্ষণ নয়। এটি সম্পর্কের প্রতি অতিরিক্ত উদাসীনতা বা আবেগিক সংযোগের অভাব নির্দেশ করতে পারে।
সংঘাত এড়িয়ে চলা: স্বামী যদি সংঘাত এড়িয়ে চলেন এবং স্ত্রীর কোনো সমস্যা বা অনুভূতির প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখান, তবে স্ত্রী নিজেকে উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে মনে করতে পারেন।
মনের কথা না বলা: স্বামী-স্ত্রী যদি নিজেদের আসল অনুভূতি বা চাহিদা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেন, তবে সম্পর্কটি কেবল একটি চুক্তিতে পরিণত হয়, যেখানে কোনো আবেগিক গভীরতা থাকে না।
রুমেট (Roommate) সম্পর্ক: সম্পর্কটি স্বামী-স্ত্রীর না হয়ে কেবল দুজন রুমমেট বা সহ-অংশীদারের মতো হয়ে যায়, যারা দৈনন্দিন কাজগুলো ভাগ করে নিচ্ছেন কিন্তু মানসিকভাবে একে অপরের থেকে দূরে সরে গেছেন।
২. সম্পর্কের প্রতি আগ্রহের অভাব
ঝগড়া করার জন্য যে মানসিক শক্তি, মনোযোগ ও আগ্রহের প্রয়োজন হয়, তা কমে গেলে বা না থাকলে বিচ্ছেদ হতে পারে।
সমস্যা সমাধানে অনীহা: স্বামী যদি ঝগড়া না করে সবসময় নীরবে সব মেনে নেন, তবে স্ত্রী ভাবতে পারেন যে স্বামী সম্পর্কটি বা স্ত্রীর সমস্যাগুলো সমাধান করার যোগ্যই মনে করছেন না।
মানসিক উত্তেজনা বা আকাঙ্ক্ষার অভাব: কিছু মানুষের কাছে সম্পর্কের মধ্যে কিছু মাত্রার আবেগিক উত্তেজনা (Passion) বা ঝগড়ার মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণ করার আকাঙ্ক্ষা থাকে। অতিরিক্ত শান্ত বা সমতল সম্পর্ক তাদের কাছে একঘেয়ে এবং "প্রাণহীন" মনে হতে পারে।
৩. নিজের অবস্থান বা ভালোবাসার অনুভূতি যাচাই না হওয়া
ভালোবাসার প্রমাণ: স্ত্রীর কোনো গুরুতর অভিযোগের পরও স্বামী যদি শুধু মেনে নেন বা ক্ষমা করে দেন, তবে স্ত্রী ভাবতে পারেন যে স্বামীর কাছে তাঁর কথা বা সিদ্ধান্ত কোনো গুরুত্বই রাখে না, বা ভালোবাসাটা হয়তো অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।
আত্মপরিচয়ের সংকট: সংঘাতের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী নিজের "স্বার্থ" বা "ব্যক্তিগত চাহিদা" প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে এক ধরনের দমবন্ধ বা অস্তিত্বহীনতা অনুভব করতে পারেন।
৪. আইনি ভিত্তি (খোলা তালাক)
বাংলাদেশে যদি স্ত্রী এই ধরনের মানসিক কারণে আর স্বামীর সাথে থাকতে না চান এবং কাবিননামায় তালাক দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তবে তিনি পারিবারিক আদালতে আবেদন করে খোলা তালাক বা বিবাহ বাতিল (ফাসখ) চাইতে পারেন।
আইনে বলা আছে, যদি কোনো স্ত্রী মনে করেন যে স্বামীর সাথে থাকা তাঁর জন্য অসহনীয় বা বিদ্বেষমূলক, তবে তিনি বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন, যদিও এর জন্য শক্ত প্রমাণ বা দেনমোহর ছাড় দেওয়ার মতো আইনি প্রক্রিয়া থাকতে পারে।
পরামর্শ:
যদি আপনার সম্পর্কটি উপরোক্ত যেকোনো কারণে এই পর্যায়ে পৌঁছে থাকে, তবে ডিভোর্সের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দাম্পত্য কাউন্সেলিং (Marriage Counseling) গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন পেশাদার কাউন্সেলর আপনাদের দুজনের মধ্যেকার আবেগিক বিচ্ছিন্নতা চিহ্নিত করতে এবং কার্যকরভাবে যোগাযোগ শুরু করতে সহায়তা করতে পারেন।
স্বামী ঝগড়া করেন না—এই কারণে কোনো স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে হলে তা আইনিভাবে একটি অস্বাভাবিক এবং দুরূহ প্রক্রিয়া হবে।
সাধারণত, বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলো (মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ অনুযায়ী) ডিভোর্সের জন্য নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট ও গুরুতর কারণগুলো বিবেচনা করে:
স্বামী ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।
স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে (শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন)।
স্বামী নিরুদ্দেশ বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে।
স্বামী তার দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
"ঝগড়া না করা" কেন ডিভোর্সের কারণ হতে পারে না?
শুধুমাত্র "স্বামী ঝগড়া করেন না" এই কারণটি আদালতে "আইনগত নিষ্ঠুরতা (Cruelty)" বা "দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা" হিসেবে সরাসরি গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আইন মূলত সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতো বাস্তব ও গুরুতর সমস্যাগুলো বিবেচনা করে।
তবে, আপনার কথায় যদি নিম্নলিখিত মানসিক সমস্যাগুলো নিহিত থাকে, তবে তা ডিভোর্সের কারণ হতে পারে:
মানসিক অবহেলা (Emotional Neglect): যদি স্বামীর ঝগড়া না করার অর্থ হয় যে তিনি সম্পর্কের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন, আবেগগতভাবে অনুপস্থিত এবং কোনো বিষয়ে আগ্রহ দেখান না, তবে এটিকে মানসিক নিষ্ঠুরতা বা দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা (Communication Gap): যদি স্বামী সব সমস্যা বা অভিযোগের মুখে দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা পালন করেন এবং কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে অস্বীকার করেন, যা স্ত্রীকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়, তবে আইনিভাবে অভিজ্ঞ একজন আইনজীবী এই বিষয়টিকে "মানসিক নিষ্ঠুরতা" হিসেবে আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন।
আপনার করণীয়:
যদি আপনার স্বামী ঝগড়া না করার নামে মানসিক অবহেলা করে থাকেন এবং আপনি সত্যিই তার সাথে থাকতে না চান, তবে আপনার উচিত:
কাবিননামা যাচাই: আপনার কাবিননামার ১৮ নং কলামে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা (তালাক-ই-তৌফিজ) দেওয়া আছে কিনা, তা পরীক্ষা করুন। যদি ক্ষমতা দেওয়া থাকে, তবে আপনি সরাসরি সেই ক্ষমতা বলে ডিভোর্স দিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে আদালতকে কারণ প্রমাণ করতে হবে না।
আইনজীবীর পরামর্শ: একজন পারিবারিক আইনজীবীর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করুন। তিনি আপনার পরিস্থিতি ভালোভাবে শুনে দেখবেন, "ঝগড়া না করা" বিষয়টি আসলে মানসিক নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়ে কিনা এবং কীভাবে এই কারণটিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্সের (ফাসখ) আবেদন করা যেতে পারে।
খোলা তালাকের চেষ্টা: যদি স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই বিচ্ছেদে সম্মত হন, তবে খোলা তালাক বা মুবারাত-এর মাধ্যমে বিচ্ছেদ নিতে পারেন। এই ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ প্রমাণ করার প্রয়োজন হয় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন